"স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো" _ নির্মলেন্দু গুণ




স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো
                      নির্মলেন্দু গুণ

একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে 
লক্ষ লক্ষ উদাত্ত অধীর বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে 
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে : "কখন আসবে কবি?" 
এই শিশুপার্ক সেদিন ছিল না
এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না। 
তা হলে কেমন ছিল সেদিনের বেলাটি
তা হলে কেমন ছিল শিশুপার্কেবেঞ্চেবৃক্ষেফুলের বাগানে 
ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি

জানিসেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত 
কালো হাত। তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ 
কবির বিরুদ্ধে কবি
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ...। 

হে অনাগত শিশুহে আগামী দিনের কবি
শিশুপার্কের রঙ্গিন দোলনায় দোল খেতে খতে তুমি 
একদিন সব জানতে পারবেআমি তোমাদের কথা ভেবে 
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প। 
সেদিনের এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর। 
না পার্ক না ফুলের বাগান, -এইসবের কিছুই ছিল না
শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকমসেরকম দিগন্ত প্লাবিত 
ধু ধু মাঠ ছিল দুর্বাদলে ঢাকাসবুজে সবুজময়। 
আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল 
এই ধু ধু মাঠের সবুজে। 

কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে 
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক
লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক। 
হাতের মুঠোয় মৃত্যুচোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত
নিম্ন মধ্যবিত্তকরুন কেরানীনারীবৃদ্ধবেশ্যাভবঘুরে 
আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে। 

একটি কবিতা পড়া হবে,তার জন্য কী ব্যাকুল 
প্রতীক্ষা মানুষের : "কখন আসবে কবি?" "কখন আসবে কবি?" 

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে 
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। 
তখন পলকে দারুন ঝলকে তরীতে উঠিল জল
হৃদয়ে লাগিল দোলা,জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার 
সকল দুয়ার খোলা।কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী
গণসুর্য্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি : 
"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" 

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের। 

Post a Comment

Previous Post Next Post