খাল পাড়ের আম গাছ । আমার জীবনের একটি বাস্তব ভৌতিক ঘটনা ।


ঘটনাটি আমার জীবনের এক বাস্তব ঘটনা । গল্প আকারে লিখলাম । যদিও আমি এখনো এসবে বিশ্বাস করিনা কিন্তু যা নিজের চোখে দেখেছি তাতো আর কোনভাবেই অবিশ্বাস করা যায়না । 

খাল পাড়ের আম গাছ
                                                                         মো: সুয়েজ

                    আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি । আমার বাবা বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করতেন বলতে গেলে গ্রামে গঞ্জে তখন আধুনিকতার ছুয়া তেমন একটা লাগেনি । শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে হওয়ায় অলৌকিক কিছুতে আমাদের ততটা বিশ্বাস ছিলনা । পড়তাম , খেতাম , খেলতাম আর ঘুরেবেড়াতামআর আমার সাত ভাই বোনের মধ্যে আমিই একটু বেশি ঘুরাঘুরি করতাম । আমার বাবা আমাকে অনেক আদর করতেন বলে আমাকে আটকে রাখার মতো ক্ষমতা বাড়িতে আর কারো ছিলনা । বন জঙ্গল , দিঘী, বিল , নদী সব কিছুই ছিল আমার ঘুরেবেড়ানোর জায়গা । আমার দাদী তখনও জীবিত ছিলেন । অনেক আগের মানুষ হওয়ায় তার মাঝে ভুত প্রেতের ব্যাপারটা একটু বেশিই কাজ করত । আমাকে যখন এদিক ওদিক ঘূরেবেড়াতে দেখতেন তখন বলতেন বনে জঙ্গলে এলো পাথারি ঘুরা উচিত না । বিপদ হতে পারে । আমি তার কথায় কখনো কান দিতাম না । আমাদের বাড়ির পিছনে একটা খাল ছিল । আর খালের ধারে একটা বড় আম গাছ ছিল । আমের সময় হলে সেখানে প্রচুর আম ধরত । এত আম ধরত যে খেয়ে কুল পাওয়া যেতনা তবে আমগুলো অনেক টক হওয়ায় কেউ গাছটার প্রতি অতটা উৎসাহী ছিলনা । আমার দাদী বলতেন এই আম গাছে লেংড়া জাতের আম ধরে । আর এই গাছেই থাকে একটা অশরীরি । তিনি ঠিক অশরীরি বতেননা, তিনি বলতেন লেংড়া থাকে এই গাছে । তিনি নাকি প্রায়ই ঐ জিনিসটাকে দেখতে পেতেন । ওটার নাকি এক পা লেংড়া ছিল আর খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলত । প্রায়ই গাছ থেকে নেমে আসত ঐ লেংড়া অশরীরিটা । মাঝে মাঝে বাড়ির অনেকের কাছে শুনতে পেতাম তারা আম গাছটাতে কিছু একটা দেখতে পেয়েছে । কেউ বলত আস্ত আগুনের ফুলিঙ্গ দেখেছি আবার কেউ বলতো কিছু একটাকে উঠতে দেখেছি । কিন্তু কাছে গেলেই নাকি সেটা মিলিয়ে যেত । কিন্তু যে যাই দেখতো সবার আগে এসে আমার দাদীকে বলতোদাদী তখনই কোমড়ে শাড়ির আচলটা গুজে ছুটে চলে যেতেন ঐ গাছটার কাছে আর মুখ দিয়ে যা আসে তাই বলে গালাগালি করতেন । আমরা ছোটরাও দাদীর সাথে সাথে যেতামদাদীর এমন কান্ড দেখতে আমাদের খুব মজা লাগত । তবে কখনো বিশ্বাস করতামনা । আমি আমার বাবাকে খুব ভালোবাসতাম । তাই বাবাকে যখন এসব কথা এসে বলতাম তিনি বলতেন এসব হয়না মা । তুমি একদম ভয় পেয়োনা আমি আর আমার বন্ধুরা মিলে প্রায় প্রতিদিনই ঐ আমগাছে গিয়ে খেলা করতাম । গাছে উঠতাম , আমের দিনে আম পারতাম তবে বেশি একটা খেতামনা । স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করার দরুন আমার বাবা আমাদের ভাই বোনদের বিশেষ করে আমার স্বাস্থের ব্যাপারে অধিক খেয়াল রাখতেন । এই দিক থেকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কড়া একজন মানুষ । তাই আমাদের সবাইকে ওনার আদেশগুলো মেনে চলতে হতো । আমার বাবা দিনে পাচ ওয়াক্তই নামাজ পড়তেনআর প্রতিদিন সকালে ফজরের নামাজটা পড়েই উনি আমাদের কে ঘুম থেকে তুলে দিতেন । আর সবাইকে ব্রাশ হাতে দিয়ে বাইরে খালি পায়ে হাটতে বলতেন । বাবার আদেশ অমান্য করার সাধ্য কারো ছিলনা । এমনকি আমারো না ।
 এমনই এক সকালের কথা । বাবা আমাদের সবাই কে ঘুম থেকে তুলে যথারীতি হাতে একটা ব্রাশ ধরিয়ে দিয়ে বাইরে হাটতে পাঠিয়ে দিলেন । বাইরে তখনো অন্ধকার কাটেনি । সবে আলো ফুটতে শুরু করেছে । আমি বেশির ভাগ সময়ই আমার বড় দাদার সাথে হাটতাম । উনি গাছে ঝুলে , শুয়ে শুয়ে , আবার কখনো দৌড়ে দৌড়ে কি যে আবলতাবল ব্যায়াম করতেন তার কিছুই বুঝতামনা । তবে দেখে খুব মজা পেতাম । কিন্তু ঐ দিন ওনার সাথেই বের হয়েছিলাম তবে কিছুদুর গিয়ে উনি এক দিকে চলে যান আর আমাকে বলেন একা একা হাটতে । আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমি দাদার সাথে থাকলে ওনার ব্যায়াম করতে অসুবিধা হয় । তাই আমিও একা একাই চলে গিয়েছিলাম আর এগোতে শুরু করলাম খাল পারের ঐ আম গাছটার দিকে । সবে শীত পড়তে শুরু করেছে বলে বেশি একটা কুয়াশাও ছিলনা । তবে কেমন অন্ধকারের মধ্যেও যেন হালকা আলো ফুটে উঠেছিলো । ঐ আম গাছটা থেকে একটু দুরে দিয়ে একটা মাটির রাস্তা গিয়েছিলআমি ঐ রাস্তাটা ধরেই হাটছিলাম । মনের আনন্দে হাটছিলাম । নিজের একদম চেনা জায়গা । তাই মনে কোনো ভয় ছিলনা আমি যখন রাস্তায় আম গাছটার একদম সোজাসুজি চলে আসি তখন গাছটার দিকে আমার চোখ পড়েআর চোখটা যেন আটকে যায় । আমি  দেখি বেশ বড়সড় একটা মরা গরু ঠিক আম গাছটার সামনেই পরে আছে । আমাদের গ্রামের প্রায় সব খবরই আমি রাখতাম । এতবড় একটা গরু মরে গেছে আর আমি জানিনা ? মনে মনে আরো অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল । হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে আমি চমকে উঠি । দেখি গরুটার উপর একটা ছোট মেয়ে বসে আছে । মেয়েটা ছোট হলেও মনে হচ্ছিলো অনেক বয়স হয়েছে । তার পড়নে ছিলো একদম সাদা রঙের ধুলো মাখানো একটা অদ্ভুত ধরনের জামা । আমার শরীর কাপছিলো তখন । আমি যেন ওখানে আটকে গেছিলাম । হঠাৎ দেখি মেয়েটা হাতে কিছু একটা নিয়ে নাড়াচ্ছে আর মুখের কাছে নিচ্ছেআর সেখান থেকে ধুয়া বের হচ্ছে । মেয়াটা তার অন্য হাতটা দিয়ে আমাকে কাছে ডাকতে শুরু করে । আর মাথা নাড়তে থাকে । আমার তখন দাদীর বলা সেই অশরীরি লেংড়াটার কথা মনে পড়ে । আমি আটকে উঠি আর চিৎকার করতে করতে এক দৌড়ে অনেকটা দুরে থাকা কিছু বাড়িতে গিয়ে উঠি সেখানে তখন কোনো মানুষ ছিলনা । সবাই ঘুমাচ্ছিল । আমি একটা ঘরের দরজায় গিয়ে জোরে জোরে ধাক্কা দিতে শুরু করি আমার চিৎকার শুনে সবাই ছুটে চলে আসে । এলাকার মেয়ে হওয়ায় সবাই আমাকে চিনত । কেউ আমাকে জিজ্ঞাস করছিল কি হয়েছে তোর । আমি কোনো কথা বলতে পারছিলামনা । শুধু বললাম আম গাছ সবাই লাঠি ঝাটা নিয়ে ছুটে গেলো আম গাছটার কাছে আমি কয়েকজন মহিলার সাথে সেখানেই রয়ে গেলাম । সবাই গেলো দেখলোও , আর ফিরে এসে আমাকে বললো সেখানে নাকি কিছুই নেই । আর তখন ভোরের আলো ফুটে গিয়েছিলো ।খবর পেয়ে বাবা ছুটে আসলো  আমাকে জিজ্ঞাস করলো কি হয়েছে ?আমি বাবাকে সব বললাম । ওখানে থাকা কেউ বিশ্বাস করলো আবার কেউ বললো ধান্দা দেখেছে । বাবা আমাকে নিয়ে আম গাছটার সামনের রাস্তা দিয়েই আসলো । আমি দেখলাম সেখানে আম গাছটা আর পিছনের জঙ্গলটা ছাড়া আর কিছুই নেই । আমি নিজেকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলামনা । বাবা এসব একদমই বিশ্বাস করতেননাতাই আমাকে নানান কথা বলে বুঝাতে  লাগলেন । কিন্তু আমার দাদী তো ছাড়ার পাত্রী নাসবাই বলতেন অশরীরিটা নাকি দাদীকে ভীষণ ভয় পেত । দাদী সাথে সাথেই চলে গেলেন আম গাছটার কাছে । আমার বন্ধুরা এসে বললো দাদী নাকি আজ অনেক কথা শুনিয়েছে লেংড়া টাকে । আর গাছটা কেটে ফেলার হুমকিও নাকি দিয়ে এসেছে
ঐ দিনটা কোনো মতো ভয়ে ভয়ে কেটে গেলো । পরের দিন ভয়টা কমলো কিন্তু আমি বাইরে বেরোনোর সাহস পাচ্ছিলামনা । আর ঐদিন আব্বু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছিলেন । আমরা রাতের খাবার খেলাম আর সবাই পড়তে শুরু করলো । আব্বু আমার মনে সাহস যোগানোর জন্য অনেক গল্প বলতে লাগলো । এই ঘটনার পর থেকেই আমি আব্বুর সাথে ঘুমাতাম । আম্মু একই ঘরের পাশের খাটে ঘুমাতো অন্য ভাই বোনেরা পাশের ঘরে ঘুমাতো । আমি আব্বুর সাথে যথারীতি শুয়ে পড়লাম । আমাদের ঘরটা ছিল পুরনো দিনের টিনের দুচালা ঘর । আর দরজার নিচ দিয়ে অনেকটা ফাকা জায়গা ছিল । প্রায় চারটার দিকে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলোআর চোখ গেলো ঐ ফাকা জায়গাটার দিকে দেখলাম সেই অশরীরি মেয়েটা । আজ মুখটা যেন বৃদ্ধদের মতো লাগছিলোআমাকে ঐ দিনের মতোই ডাকছিলো আর হাসছিলো । আমি চিৎকার দিয়ে উঠি আর বাবাও উঠে পড়ে । বাবারও চোখ পড়ে ঐ অশরীরি আত্মাটার দিকে । উনি একঝাপ দিয়ে উঠে পড়লেন । উনার লঙ্গিটাও খুলে পড়ে গেছিল । মা আর অন্য ভাই বোনেরা ঘরে চলে এলো লাইট জ্বালালোবৃদ্ধা ছোট মেয়েটা তখন আর ওখানে ছিলনা । আমার দাদী তখনই একটা দা নিয়ে গাছটার কাছে গেলেন আর সেই দিন দাদীর সাথে কেউ যায়নি ওখানে । দাদী এসে বলেছিলেন , উনি নাকি গাছে কয়েকটা কোপ দেওয়ার পর ডালের উপর লেংড়া টাকে দেখতে পান । লেংড়া টা নাকি দাদীর কাছে মাফ চেয়েছিলো । আর এটাও নাকি বলেছিলো সে আর কখনো আমাদের কে এভাবে জ্বালাবেনা । দাদী তাই গাছটা কাটেনি । কিন্তু আমার বাবা এসবে বিশ্বাস না করলেও গাছটাকে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । পরের দিন তিনি মানুষ ডেকে আনেন গাছটা কাটার জন্য আমরা সবাই দেখতে যাই । দেখতে পাই গাছের গোড়ায় অনেক গুলো কোপ দেওয়া । বুঝতে পাড়ি দাদীই দিয়েছিলো । দাদী বাবাকে বারণ করে গাছটা না কাটতে । কিন্তু বাবা নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলো । ঐ দিনই গাছটাকে কেটে ফেলা হয়েছিল ।গাছটার জন্য দাদী অনেক কেদেছিল এর পর থেকে আমি বা আমাদের বাড়ির কেউ এমন অদ্ভুত কিছু দেখতে পায়নি । তবে শুনেছি এখনো খাল পাড়ের কাছের বাশ ঝাড়টা থেকে গভীর রাতে ঠক ঠক আওয়াজ পাওয়া যায় । যদিও দিনের বেলায় সেখানে বাশ কাটার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়না ।



Post a Comment

Previous Post Next Post